এল নিনো ও লা নিনা কি ভাবে ভারতের মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত করে

এল নিনো ও লা নিনা: ভারতের বর্ষাকাল শুধুমাত্র একটি ঋতু নয়, এটি দেশের কৃষি, অর্থনীতি এবং কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে এই বর্ষা একা কাজ করে না। একে চালিত করে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীর জলবায়ু চক্র— এল নিনো ও লা নিনিয়া। এই দুটি প্রাকৃতিক ঘটনা ভারতের মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও সময়কে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

এল নিনো ও লা নিনা কী?

এল নিনো ও লা নিনা হল এনসো (ENSO – El Niño Southern Oscillation) চক্রের দুটি বিপরীত অবস্থা। এরা গড়ে প্রতি দুই থেকে সাত বছরে একবার ফিরে আসে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়া ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনে।

  • এল নিনো: যখন প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের পৃষ্ঠের জল অস্বাভাবিকভাবে গরম হয়ে যায়, তখন সেটিকে এল নিনো বলা হয়। এতে ভারতের মৌসুমি বৃষ্টিপাত কমে যায়।
  • লা নিনিয়া: এর বিপরীতে, যখন একই অঞ্চলের সাগরের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, তখন তাকে বলা হয় লা নিনিয়া। এটি ভারতের জন্য তুলনামূলকভাবে ভালো বর্ষা বয়ে আনে।
এল নিনো ও লা নিনা

বর্ষায় এল নিনোর প্রভাব

এল নিনো ভারতের জন্য একটি বিপজ্জনক সংকেত। এটি সাধারণত দুর্বল, দেরিতে আসা এবং অনিয়মিত বর্ষার কারণ হয়।

  • গরম সাগরের কারণে বৃষ্টির মেঘ তৈরি কম হয়।
  • ভারত মহাসাগরের নিম্নচাপ দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে যায় এবং বর্ষা দেরিতে আসে।
  • এর ফলে খরা, ফসলহানি এবং খাদ্যের দাম বৃদ্ধি ঘটে।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালের একটি তীব্র এল নিনো বছরে ভারত ১৪% কম বর্ষা পেয়েছিল, যার ফলে কৃষক ও সাধারণ মানুষের ওপর চরম প্রভাব পড়ে।

বর্ষায় এল নিনোর প্রভাব

লা নিনিয়া: বর্ষার জন্য আশীর্বাদ

লা নিনিয়া বছরের বর্ষা সাধারণত সময়মতো এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়।

  • ঠান্ডা সাগর ভারত মহাসাগরের উপর নিম্নচাপ সৃষ্টি করে।
  • বায়ুপ্রবাহ ও মেঘ তৈরি সক্রিয় হয়।
  • ফলস্বরূপ, দীর্ঘস্থায়ী ও প্রচুর বর্ষা হয়।

২০২০ সালে একটি শক্তিশালী লা নিনিয়া বছরে, ভারত গড়ের চেয়ে ৯% বেশি বর্ষা পেয়েছিল, যা ফসলের রেকর্ড উৎপাদনে সাহায্য করেছিল।

লা নিনিয়া: বর্ষার জন্য আশীর্বাদ

কৃষি ও অর্থনীতিতে প্রভাব: তুলনামূলক চিত্র

নিচের ছকে এল নিনো ও লা নিনিয়ার বিভিন্ন প্রভাব তুলে ধরা হলো:

জলবায়ু চক্রবর্ষার প্রভাবকৃষিতে প্রভাবঅর্থনৈতিক প্রভাব
এল নিনোদুর্বল, দেরিতে বর্ষাখরা, ফলন হ্রাসখাদ্য সংকট, মুদ্রাস্ফীতি
লা নিনিয়াপ্রবল, নিয়মিত বর্ষাঅধিক উৎপাদনগ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা

জলবায়ু পরিবর্তন ও ভবিষ্যতের ঝুঁকি

যদিও এল নিনো ও লা নিনিয়া বর্ষার গতিপথ ঠিক করে, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব চক্রের তীব্রতা ও পূর্বাভাসযোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে। অনেক সময় এল নিনো থাকলেও স্বাভাবিক বর্ষা হয়, আবার লা নিনিয়ার সময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি বন্যা সৃষ্টি করতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ঘটনাগুলোর ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি ও চরমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে কৃষি, জলসম্পদ এবং অর্থনীতি আরও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে।

এল নিনো ও লা নিনা কি ভাবে ভারতের মৌসুমী
এল নিনো ও লা নিনা কি ভাবে ভারতের মৌসুমী

উপসংহার – এল নিনো ও লা নিনা

ভারতের বর্ষা যেন এক সূক্ষ্ম সুরের মতো—একটু ভারসাম্য নষ্ট হলেই পুরো ব্যবস্থার সুর কেটে যায়। এল নিনো ও লা নিনিয়া সেই অদৃশ্য সুরযন্ত্রকার, যারা দুর্দান্তভাবে এই বর্ষাকে চালিত করে। সঠিক সময়ে এই ঘটনাগুলো চিহ্নিত করতে পারলে সরকার ও কৃষকরা আগাম প্রস্তুতি নিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে।

সুতরাং, আধুনিক আবহাওয়া প্রযুক্তি, সজাগ সরকারী পরিকল্পনা এবং সচেতন নাগরিক উদ্যোগ-ই ভবিষ্যতের ভারতকে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

সাধারণ কিছু প্রশ্ন এল নিনো ও লা নিনা (প্রশ্নোত্তর)

প্রশ্ন ১: এল নিনো কী এবং এটি ভারতের ওপর কী প্রভাব ফেলে?
উত্তর: এল নিনো হল একটি গরম সাগরের জলবায়ু চক্র, যা ভারতের বর্ষা দুর্বল করে এবং খরা সৃষ্টি করতে পারে।

প্রশ্ন ২: লা নিনিয়া কি সবসময় ভালো ফল আনে?
উত্তর: সাধারণত হ্যাঁ, তবে অতিরিক্ত বর্ষার কারণে কিছু এলাকায় বন্যার ঝুঁকিও থাকে।

প্রশ্ন ৩: এই চক্রগুলো কত ঘন ঘন ঘটে?
উত্তর: প্রায় প্রতি ২–৭ বছর পরপর এল নিনো বা লা নিনিয়া দেখা যায়।

প্রশ্ন ৪: ভারত কি এল নিনোর কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, উপযুক্ত পূর্বাভাস, জল সংরক্ষণ এবং ফসল পরিকল্পনার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো যায়।

প্রশ্ন ৫: জলবায়ু পরিবর্তন কি এই ঘটনাগুলোর ঘনত্ব বাড়াচ্ছে?
উত্তর: হ্যাঁ, এটি এল নিনো ও লা নিনিয়ার তীব্রতা এবং অসংগতিপূর্ণতা বাড়িয়ে তুলছে।

আরও শিক্ষামূলক এবং সংবাদ নিবন্ধের জন্য ‘ওয়াটান্টাক‘ দেখুন।

Leave a Comment